বৃহস্পতিবার, ২২ জুলাই, ২০২১

রঙ চং

চোখের সামনে ঘটতে থাকা জীবন খুব সাধারন-সাদামাটা-সাধাসিধে-বড্ড চেনা। এক তালে চলছে ঘড়ির কাটার সাথে টিক টিক টিক টিক-এক সেকেন্ড এখানে এক সেকেন্ডেই শেষ হয়, ঘন্টা হয় ৬০ মিনিটে, ২৪ ঘন্টায় শেষ হয় এক দিন। কিন্তু ডিজিটাল ক্যামেরার চোখে? মানুষের চোখের ঐ চিরচেনা আই লেভেল আর ১৭ মিলি এর লেন্সে আটকে নেই-জুমে যাচ্ছে, উপরে যাচ্ছে, নিচে যাচ্ছে, চাই কী চলে যাচ্ছে পাখির চোখে। দিন চলে যাচ্ছে চোখের পলকে, বিটের তালে তালে, মাপা মাপা ট্রানজিশনে-আবার পলকের মাঝে হারিয়ে যাওয়া মুহুর্তকে টেনে হিচড়ে মিনিটে কাটাচ্ছি। বাস্তবের জীবনে ছন্দ পতন নেই-আবহ সংগীত নেই-নির্লিপ্ত ভাবে বাস ট্রাকের আওয়াজের মাঝেই হয়ত গান গেয়ে উঠে কেউ কেউ।

চোখের সামনে ঘটতে দেখা ভয়ানকতম, আশ্চর্যতম, নিকৃষ্টতম ঘটনাটাও স্বাভাবিক যেন। একটা গুলি চলতে সময় লাগে ১ সেকেন্ড, লাগতে মিলি সেকেন্ড, আর শেষ নিঃশ্বাস টা বেরিয়ে যেতে ২ সেকেন্ড। কিন্তু ক্যামেরায়? পর্দায়? মোবাইলের টাচ দেয়ালে? সেখানে সময় আটকে যাবে, সাউন্ড ইফেক্টে বুক টা কেপে উঠবে, নেপথ্যে ভাষ্যকার করে উঠবেন আর্তচিৎকার, পর্দায় আসবে আতংকের বানী-শেষে থাকতে পারে কল টু একশন। তবেই না বাস্তবের ভয়ংকর রূপটা মানুষের মনে ঢুকবে। গনপিটুনির ভিড়ভাট্টার একদম পিছে থাকা লোকটার থেকে সিসি ক্যামের সামনে বসে থাকা লোকটা পিটুনির ভয়াবহতাটা ভালভাবে দেখে।

এই কায়দাগুলি কাজে লাগিয়ে বাস্তবটাকে রঙ চড়িয়ে খুব সাদামাটা জিনিসও আজকাল দেখার মত। ফেসবুকে লোকজন খেতে যাচ্ছে, বাসে চড়ছে, কাজে যাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, খেতে কাজ করছে, মুলো শাক বাছছে, পেয়াজ ভাজছে, বোতল ভাংছে, গাড়ি চাপছে, পাহাড় বাইছে, চানাচুর খাচ্ছে, মাংস কাটছে, ছবি তুলছে, আলু বুনছে-সবাই দেখছে। দেখছে। চোখের সামনেও এসব ঘটছে-কিন্তু পর্দায় দেখছে। গিলটি প্লিজার-নির্দোষ আনন্দের উলটো। নিষ্ক্রিয় আনন্দ। সম্মোহনের আনন্দ। হোয়াইট নয়েজ। হোয়াইট নয়েজ। হোয়াইট নয়েজ। সবই কনটেন্ট, সবাই কনজিউমার। পাচ মিনিটের ক্রাফট, পাচ মিনিটের শব্দ আর আলোর মিক্সচার। টুক করে খেয়ে নিন-সহজ পাচ্য। পুষ্টীগুন? শিক্ষা? বিনোদন? কুশিক্ষা? কিছু পাবেন না-পাচ মিনিটের খোরাক-পাচ মিনিটেই গায়েব।

বুড়ো মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা যুগে যুগে ছিল, আছে, থাকবে। এসবে পাত্তা দিবেন না।






রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১

আমার সিংগাড়া খেতে ভাল লাগে না

 ইদানিং সিংগাড়া খেতে আর ভাল লাগে না। আগে মনে আছে সিংগাড়া অনেক মজা করে খেতাম। ফকিরাপুলের কাছের অফিসের নিচের দোকানে খাওয়া সিংগাড়ার কথা অনেক মনে পড়ে। অফিস কাজের ফাকে ১১-১২ টার দিকে এনাম ভাইকে নিয়ে টুক করে বসের চোখ এড়িয়ে নিচে চলে যেতাম। অফিসপাড়ার গরম থাকত দোকানটায়-শেয়ার, লোন, টাকা, কড়ির আলোচনার মধ্যে সাদা প্লেটে বড় বড় কাটা পেয়াজ সহ চলে আসত সিংগাড়া।  ভেতরে বাদাম থাকত, নাকি থাকত না-আলুর সাথে কি মাখিয়ে যে সিংগাড়া গুলো তৈরী হত জানি না। ফু দিয়ে টকে ডুবিয়ে সেই সিংগাড়া খাওয়া হয়নি অনেক দিন। এখন খেতে গেলে এসিডিটি, গ্যাসট্রিক এসবের চিন্তা সেই স্বাদকে আটকে দিতে চায় মনে হয়। সিংগাড়া এখন খেতে গেলে খোলস টা মোটা মনে হয়-নিচের কোনার দিকের অংশ গুলো ভেঙ্গে রেখে দেই। কারন ওখানে খাবার মত কিছু নেই-শুধু পেয়াজ কাচা মরিচ আর টক দিয়ে একসময় ঐ মুড়োন খোলস গুলো ও খেয়ে ফেলতাম।

তবে এখন সমুচা ভাল লাগে। তিনকোনা পাতলা পরতের সমুচা-এর সাথে পেয়াজ চলেনা। তেতুলের টক হলেও সই, না হলেও ক্ষতি নেই। ভেতরে ক্যারামেলাইজড পেয়াজ, ঝালের বাড়াবাড়ি নেই, আলুর বাড়তি নেই। তিন কামড়ে একটা শেষ-ছোট ও হতে পারে, এক বারেই মুখে চলে যাচ্ছে। প্রথম কামড়ের পর টকে ডুবিয়ে অন্য রকম একটা দ্বিতীয় কামড়। স্কুলের কথা মনে পড়ে যায় সমুচায়-টিফিন টাইমে ফ্রেন্ডস কর্নার, ছুটির দিনে হার্ট ওয়ার্ল্ড-তেতুল বিচি ভাসা বাদামি রঙ এর টক-টিনের প্লেটে সমুচা। ২ টাকা পিস হয়ত।

এখন তাই সমুচা খাই। সিংগাড়ার স্বাদ নিতে ভুলে যাচ্ছি-সমুচার প্রেম আবার ফেরত আসছে। ৩০ এর দশক টাই নাকি এমন-স্কুল ফ্রেন্ডরা আবার অনেক আপন হয়ে যায়। নস্টালজিয়া ফেরত আসতে থাকে- স্মৃতির কুয়াশা ঘেরা অলি গলি হাতড়ে বেড়াতে মন চায়। অনেক অনেক দূরে চলে যাবার আগে মেমোরি গুলোকে আর একবার ঝালিয়ে নিয়ে সময়গুলো বয়ে যেতে দেখা।

বুধবার, ৭ জুলাই, ২০২১

আমাদের শেষ নিঃশ্বাস কবে ছিল?

 আমাদের শেষ নিঃশ্বাস কবে ছিল?

শেষ কবে প্রান খুলে শ্বাস নিয়েছি?

মহামারীর দিন গুলি কেটে যাচ্ছে একটার পর একটা, সিনেমায় মেশিন গান থেকে যেভাবে গুলির খোসা একটার পর একটা ছন্দে পড়তে থাকে সেভাবে। বৈচিত্র ছাড়া একটানা।

কিন্তু তার আরো অনেক অনেক আগেই, আমরা কি শেষ নিঃশ্বাস টা নেইনি?

দায়িত্ব, জীবন বাস্তবতা, সংসার, চাকরি- এসব কিছু কি আসলে মুখোশ? আমাদের ভেতর টা কী আরো আগেই মারা যায়নি?

কাজ কর্ম চাকরি বাসা বাড়ি-এসবের আড়ালে থেকে আমরা ভাবি জীবনটা কেটে গেল এই করতে করতে-কত কি না করতে পারতাম এসব না থাকলে। কিন্তু আমরা স্বীকার করিনা যে এগুলি না থাকলেও আসলে আমাদের কিছু করার নেই আসলে। আমরা রোমান্টিসাইজ করতে পারি যে অনেক কিছু করতে পারতাম হয়ত অবসর পেলে, কিন্তু অবসরে কিছু করার মন আমাদের আর হয়ত নেই।

নতুন গান শুনে এখন আর অবসর ক্যাটাতে পারি? একটা নতুন গান নিজের পুরনো ৯০, ২০০০ দশকের প্লে লিস্টে জায়গা করে নিতে পারে? কোন সিরিজে শুনা একটা গানের লিরিক লিখে ইন্টারনেটের তস্য গলি ঘুপচি ঘেটে ইন্ডি, পপ, রক গান বের করার ইচ্ছা টা তো মরে গেছে।

অবসর পেলে এখন আর ইচ্ছা করে না নতুন গেমটা খেলি। একটু অবসরে ঝির ঝিরে মনিটরে কনভার্টার কেবল লাগিয়ে গেম খেলার ইচ্ছে গুলো মরে গেছে-মৃত জম্বি লাশকে টেনে আনার মত গেম বানাবার চেয়ে এখনকার অবসর কাটানো মনকে আকর্ষন করা সহজ। তাই গেম গুলিও সেই আগের ট্রোপেই ঘুরপাক খায়-ঝা চকচকে গ্রাফিক্সে এখন খেলতে পারলেও জীবনের সেরা গেম বলে মনে হয় ১৪ ইঞ্চি সি আর টি মনিটরে স্কুল ফাকি দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলে শেষ করা এক অখ্যাত গেম।

এখন আর ভাবা যায়-অবসরে এক পাল ছেলে পেলে মিলে একই রকম ড্রেস পরে, ঝুম বৃষ্টী কাদায় কাক ভেজা হয়ে নিশ্চিন্তে হাটতে হাটতে বাড়ি ফেরা? মোবাইল ভেজার ভয় নেই, মানিব্যাগের কার্ড হারাবার ভয় নেই, জুতো কাদা মাটিতে নষ্ট হবার ভয় নেই, চুল ভিজে ঠাণ্ডা লাগার ভয় নেই, ছাতা রেইনকোটের বালাই নেই-এখন আর ভাবা যায়? সব দায়িত্বের মুখোশ টেনে ফেললেও তো ইচ্ছে গুলো জাগে না আর।

তাই আমরা ডুব দেই কাজের আড়ালে। ব্যাস্ততা, ম্যাচিউরিটি, কাজ, গাম্ভীর্য এর আড়ালে লুকোই। নিজেকেও হয়ত বোঝাই সময় নেই বলে হচ্ছে না কিছু। কিন্তু আয়নার সামনে দাড়ালে বুঝেই যাই, ঐ পুরনো ছেলেটা মরে গেছে।