রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

আঁকার হাতে খড়ি-পর্ব ১

একটা খুব কমন প্রশ্ন-ভাই, আপনি কিভাবে আকেন? কিভাবে আকা শিখলেন? আমি কিভাবে আকা শিখব?

আমার মত কিভাবে আকি? আমার মত করে আকান মানে কি?আমার মত করে আকা কি শেখা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব- ডিজনি তে চাকরি পাওয়া আর্টিস্ট দের ডিজনি স্টাইল ধরে ধরে শেখান হয় যাতে সবার আকার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। সে তো কাজের জন্য শিখে আকা। তার পেছনে অনেক পরিশ্রম আর এনালাইসিস আছে যাতে স্টাইল টাকে তার মূল পয়েন্টে ভেঙ্গে শেখান যায় সবাইকে। 

তবে আমি আমার স্টাইলকে ভেঙ্গে চুরে অমন একটা সিলেবাস ধরে শেখানোর মত করে ভাবিনি। সেটা পুরোপুরি শিক্ষামূলক প্রজেক্ট-সেকাজে সময় দেয়ার মত এক্সপার্টিজ বা নিজের জ্ঞান নিয়ে অত খানি কনফিডেন্স আমার নেই। যে নতুন আকতে শিখছে তাকে আমার স্টাইলে আকতে শেখানোর কোন চেষ্টাও আমার নেই। স্টাইলে আকতে শেখার বিষয়টাও গোলমেলে। কারন আকার মূল যে বিষয়গুলি-ফর্ম, লাইন, শেপ, জেশচার, কম্পোজিশন, কালার, শেডিং-এসব না আলাদা আলাদা করে এপ্লাই করার উপায় নেই। সব কিছুই এক সাথে একটা ছবিতে কাজে লাগে। আলাদা আলাদা করে জিনিসগুলি শেখা বিরক্তিকর, কিন্তু আলাদা না শিখে আকতে আকতে শেখাও সময়সাপেক্ষ। তাহলে আঁকা শেখার প্রথম ধাপ কি? কোনটা ছেড়ে কোনটা শিখব? এত এত কিছু শিখতে হবে-কিভাবে একটা প্রসেসে এগুলি শিখব? কোথা থেকে শুরু করব? কাকে ফলো করব?

আকতে শেখার প্রসেস টা অনেকটা আমার মনে হয় ছোটবেলায় ভাষা শেখার মত। লিখতে শেখা আর কথা বলতে শেখা-দুটো কিন্তু সম্পূর্ন আলাদা বিষয়। আমরা বাংলা যেভাবে শিখি-তা কিন্তু কথা বলতে বলতে শেখা। ছোট বাচ্চারা শুনে শূনে কথা জোড়া লাগিয়ে অনেক কথা বোঝাতে পারে। ব্যাকরন, কথ্য, চলিত, সাধু, সমাস-এত শত বিষয় তার মাথায় রাখতে হয় না। কিন্তু এগুলো না শিখলে আবার শেখা টা কিন্তু পূর্নতা পায় না। বলতে বলতে বা শুনঅতে শুনতে যে শেখা , সেটি কিন্তু লিখিত রূপের শিক্ষা দেয় না। ভাষার নান্দনিকতার শিক্ষা দেয় না। কোন বাচ্চাকে চাইলে কবিতা মূখস্ত করে বলান যাবে কিন্তু সেই কবিতার ভাব বোঝার সামর্থ্য তার তখনো হবে না। তবে বাচ্চা দের কাছে কথা বলার মূল যে লক্ষ-অর্থাৎ কমিউনিকেশন, সেটার জন্য কিন্তু এত নিয়ম কানুন ডিঙ্গিয়ে কথা শুনা আর বলতে চেষ্টা করার কাজটাই মূখ্য। দুটি পাশা পাশি শিখতে শিখতেই ভাষার দক্ষতা অর্জন সম্ভব। আমরা অনেক সময় ইংরেজি যেভাবে শিখি-তাতে খাতা কলমে নিয়ম নীতি মেনে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি-কিন্তু বলতে গেলে জড়োসড়ো হয়ে যাই। সাবলীল ভাবে বলার দক্ষতা অর্জন এর জন্য ইংরেজি শুনা বা আধো আধো বলতে চেষ্টা করার যে প্র্যাকটিস টা সেখানে একটা ফাক থেকে যাওয়ায় এই জড়তা টা কাটে না।  এখানে বলতে বলতে শেখা, শিখতে শিখতে এপ্লাই করা-এমন অনেক প্রসেসের একটা মিথস্ক্রিয়া এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। 

এখন এই প্রসেস টার সাথে চিন্তা করেন ছবি আকা শেখার প্রসেসটা। প্রচুর বিগিনার আর্টিস্ট, তারা ক্রমাগত জানতে চাচ্ছেন কিভাবে আকলেন, কোন সফটওয়ারে আকলেন, কোন ট্যাবে আকলেন, কতক্ষন ধরে আকলেন, কোন ব্রাশ ব্যবহার করলেন-ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। টেকনিকাল এসব নানা প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার অবশ্যই-তবে এ উত্তর গুলি জানা ছবি আকা শেখার পথের অনেক অনেক দূরের ধাপ। ধরুন আপনি ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে চান, ফ্রেঞ্চ একজন রাইটার কোন কলমে লিখছেন সেই প্রশ্নের উত্তর জানার প্রয়োজন থাকতে পারে-কিন্তু সেই ব্রাণ্ডের কলম কিনলে তা দিয়ে ফ্রেঞ্চ লেখা বের হবে এই চিন্তা হাস্যকর। ছবি যারা আকছেন, বিগিনার স্টেজে আছেন, প্রথমে এই বিষয়টা মেনে নেওয়া জরুরী। আপনার হাতের কাছে ইউটিউব, আর্টস্টেশন, ছবির ব্যাকরন নখদর্পনে, ড্রয়িং ট্যাব আর পিসির স্পেক ঠোটের ডগায়, ফোনের স্ক্রিনে ড্রয়িং এর এপ -এত অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিজেকে বিগিনার ভাবাটা কঠিন। কিন্তু এটাই শুরুর ধাপ। নিজেকে কল্পনা করুন ভাষা শিখতে বসেছেন- সব কিছু দূরে সরিয়ে জরুরী ঐ আধো আধো কথা বলে কিছু বুঝাতে শেখা। হ্যা, আপনি যদি একটা কবিতা মুখসত করে স্কুলের ফাংশনে বলেন, লোকে হাততালি দিবে, বাহবা দিবে, বাচ্চাদের যেমন উতসাহ দেয়। কিন্তু সেই বাচ্চাকে এজেন্সি অফিসে কপিরাইটিং এ বসিয়ে বলুন-দারুন কবিতা পার তুমি-লিখে ফেল ঝট পট তাহলে দু তিনটে-কাজ হবে?

মিমিক্রি না-বিষয়গুলিকে আত্মস্থ করার একটা প্রক্রিয়া এর মধ্য দিয়ে যেতে হয় সবাইকে। একটা সত্য ঘটনা বলি। মোটীভেশনাল গল্প বলা যেতে পারে-তবে গল্পের স্থান, কাল, পাত্র-কিছুই খেয়াল নেই। এক ঘোড়া নাকি অংক করতে শিখেছে। সাধারন অংক-এক অংকের সংখ্যার যোগ বিয়োগ ধরনের। তাজ্জব ব্যাপার। সাজানো বলা যায় না কারন ঘোড়ার মালিক সজ্জন ব্যাক্তি-সত্যিই তার বিশ্বাস তার ঘোড়া অংক করতে পারে। কিভাবে করে অংক? একটা হোয়াইট বোর্ডে লেখা হয় দুটো সংখ্যার মাঝে যোগ চিহ্ন দিয়ে-তারপর ঘোড়া যোগফলের সমান সংখ্যক বার খুর ঠুকে। ঘোড়ার মালিকের কোন কারসাজি নেই-অনেকেই নিজেদের মত করে প্রশ্ন লিখে দিয়েছে-ঘোড়া ঠিক ঠিক খুর ঠুকে সঠিক উত্তর দেয়। পরে যখন এই দাবী নিয়ে পরীক্ষা চালান হল সবাই অবাক। ঘোড়ার মালিক আসলেও নির্দোষ। তার ঘোড়া অংক না পারলেও মানুষের এক্সপ্রেশন পড়তে ছিল তুখোড় দক্ষ। ঘটনাটা ঘটেছিল এমন যে, প্রশ্ন টা লিখে সামনে একজন দাঁড়িয়ে থাকত ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে। ঘোড়া বুঝে ফেলেছিল এমন ভাবে তাকালে তাকে খুর ঠুকতে হবে। সঠিক সংখ্যক বার খুর ঠুকার আগ পর্যন্ত প্রশ্নকর্তার চোখে একরকম প্রশ্নের এক্সপ্রেশন থাকত-ঘোড়া যদি যোগফলের সমান খুর ঠুকত তখন এক্সপ্রেশন পালটে একটা অবাক বা বিস্ময়ের এক্সপ্রেশন চলে আসত। এ সময় ঘোড়া বুঝেছিল খুর ঠোকা থামিয়ে দিতে হবে। এভাবে উত্তর ঠিক দিত বটে ঘোড়া কিন্তু যোগফলের নিয়ম কানুন সব ডিংগিয়ে। পাবলিক রিএকশন এনালাইজ করে অনেক বাহবা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সেই ঘোড়াকে দিয়ে দোকানে হিসাবের কাজ চলবে না।

তাহলে কিভাবে শিখব? 

সবার আগে ভাবুন ছবি আকা শিখতে আপনার উদ্যেশ্য কি আসলে? পেজ খুলে ফেমাস হওয়া নাকি নিজের মত আকতে শেখা , বোরডম কাটান,  প্রফেশনালি স্টূডিও জব করা, এনিমেট করে গল্প বলা, নিজের মত ক্যারেক্টার আকতে শেখা, নাকি ফ্রিল্যান্স কাজ করার জন্য ছবি আকা শেখা। এই অবজেকটিভ মাথায় থাকাটা খুব জরূরী। তাহলে সেই ভাবে নিজের রিসার্চ, বা স্টাডি এলিমেন্ট গুলিকে সিরিয়ালি সাজিয়ে নিতে পারবেন। হয়ত আপনার ইচ্ছা খুব সিমপ্লি কমিক স্ট্রীপ আকান। আপনি আর্ট স্টেশনের রিয়ালিস্টিক গেম ক্যারেক্টার দেখে স্টাডি করতে থাকছেন। আপনি শখের বশে জলরং এ ফুল ফল আকতে চান-আপনাকে কঠিন কম্পোজিশন আর কালার থিওরী এর বই গুলে খাওয়ান নিস্ফল। এজন্য যেটাতে মজা পান সেটা দিয়েই স্টাডি চালান জরুরী। 

তারপর? খুব সহজ- এতই সহজ যে সেটা চিন্তা করাটা কঠিন।

শেখার প্রথম ধাপ আকতে শুরু করুন। যেমন পারেন, যতটুকু পারেন। বাচ্চারা আধো আধো বোলের জন্য বাহবা পায়-বড়োরা আধো আধো বোলের জন্য পায় সমবেদনা। কিন্তু এতে দমে যেয়েন না। আপনার আকা শুরুতে কিছুই হবে না, তুখোড় আর টি এক্স গ্রাফিক্স কার্ড লাগান পিসিতেই হোক, আর পাচ টাকা কলমে বিশ টাকার খাতাতেই হোক-হাতে খড়ি পর্যায়ে এই স্ট্রাগল টাই মূল-শুরু করা। বলতে যত সহজ-করতে তত সহজ নয়। নিজের কাছে কাজটাকে এনজয় করতে শিখুন-কালিতে, তুলিতে, জল রঙ পেন্সিলে প্রতিদিন কিছু না কিছু আকুন। ৩০ দিনে একটা খাতা ভরাট করতে পারেন কিনা চ্যালেঞ্জ টা নিয়েই দেখুন না। কোন একটা কাজকে অভ্যাসে পরিনত করটা কঠিন-কিন্তু করতে পারলে তার ফল সুদূর প্রসারী। তাই আকাস কুসুম কল্পনা র রাশ টেনে ধরে, আর হচ্ছেনা হবেনা পারবনা লোকে হাসবে, আমার টা কেন অমন হচ্ছে না, এসব চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে একবার খাতা কলম নিয়ে বসেন। আকুন যা ইচ্ছে যেমন ভাবে ইচ্ছে। চিন্তা করুন আপনি কথা বলতে শিখছেন-কেউ আশা করেনা আপনি কালকেই সাবলীল ভাষন দিবেন মানুষের সামনে-তবে একদিন সেই মঞ্চে দাড়াতে চাইলে আপনাকে প্রথম স্টেপ টা নিতেই হবে। 

তাই চলতে থাকুক আকা আকি।

দ্বিতীয় পর্বঃ https://artsbyrats.blogspot.com/2021/06/blog-post_24.html


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন