বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১

আঁকার হাতে খড়ি-পর্ব ২

প্রথম পর্ব

আঁকতে শেখার ব্লগের দ্বিতীয় পর্ব-আকার হাতে খড়ি এর পর কী আসে? ক্লাস ১, ২, ৩, ৪ করে যেভাবে আমরা পড়তে পড়তে আগাই তেমন কোন সিলেবাস-গাইড লাইন কি ছবি আকার ক্ষেত্রে করা সম্ভব? নিশ্চয় সম্ভব-সারা বিশ্বে এত এত আর্ট স্কুলে কারিকুলাম করেই নিশ্চয় শেখান হচ্ছে। তবে ক্যাজুয়ালি আর্ট শেখার শুরু কিভাবে হতে পারে?একশনেবল কিছু পয়েন্ট কি নোট করা যেতে পারে আকা শেখার জন্য? 

থিওরি, গ্রামার এসব দূরে রেখে শুরুতেই বলি মাইলেজের কথা। মাইলেজ ছবি আকার জন্য খুব ইম্পরটান্ট একটা টার্ম- মাইলেজ মানে কতগুলি ছবি আপনি আকলেন-ছবি আকার কতখানি অভিজ্ঞতা জমা হল আপনার ঝুলিতে। কিছু না জেনে বুঝে একই ছবি ১০০ বার আকলেও কিন্তু আপনার প্রথম চেষ্টার থেকে ১০০ নম্বর চেষ্টার আউটপুট বেটার আসবে। 

মাইলেজ বা আকতে আকতে শেখার পাশা পাশি কিছু টাচ পয়েন্ট ধরে ধরে ও আকার প্রগ্রেস আগানো যেতে পারে। এগুলির জন্য সব থেকে ভাল খাতা কলমে আকান। ডিজিটাল সফটওয়্যার, ট্যাব, এন্ড্রয়েড, আইপ্যাড, স্টাইলাস, এপ্স-এসবে একসেস না থাকলে আকা শেখায় গোড়ায় গলদ ভেবে বসে থাকলে কাজের কাজ হবে না।  এই সহজ কথাটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আমি আমার নিজের লাইফেও পদে পদে অনেক সময় অনেক কাজ শুরু করার কথা ভাবিও এবং অনেক টাকা পয়সা খরচ করে প্রো স্কিলের গ্যাজেট কিনে শেষ মেষ রেগুলারিটি এবং প্র্যাকটিসের অভাবে ফেলে রেখে দেই। মনে রাখবেন আপনি আধো আধো কথা বলতে শেখা এক শিশু মাত্র-আপনার গান হাই কোয়ালিটি মাইকে সাউন্ডপ্রুফ রুমে রেকর্ড করলেও তাতে আপনার গলা দিয়ে প্রফেশনাল গান বের হবে না।

যেকোন ভাষা শিক্ষার প্রসেসের ভেতরে অনেক রকম থিওরি, অনেক রকম হাইপোথিসিস আছে। ছবি আকা যেহেতু কমিউনিকেশনের ই একটা মিডিয়াম বা ভাষা-তাই এখানের চ্যালেঞ্জ গুলিকে ভাষা শিক্ষার চ্যালেঞ্জ দিয়ে অনেক সময় ব্যাখ্যা করা যায়।  ভাষা শেখার মনিটর মডেলের ইনপুট হাইপোথিসিস বলে আপনি তখন ই ইফেকটিভলি শিখবেন যখন আপনার স্কিল লেভেলের থেকে অল্প একটূ হাই লেভেলের স্কিলের চ্যালেঞ্জ ফেস করবেন। অনেক হাই স্কিলের টাস্ক আপনাকে ফ্রাসট্রেট করে দিবে যেটা আমরা বিগিনার স্টেজে আর্টস্টেশন, ইন্সটাগ্রামে খুব ফেস করি। ওয়ার্লড ক্লাস লেভেলের নিচের কোন কাজ আপনার হোমে হয়ত আসে না এবং সেই কাজগুলিকে আপনার স্কিল দিয়ে ইন্টারপ্রেট করাই দুষ্কর-এক্সিকিউশন তো দূরে থাক। শুরুতে ভিজুয়াল লাইব্রেরী তে তাই সহজ ধরনের কাজ দিয়ে বিল্ড আপ করুন-যেটা দেখলে মনে হবে বাহ-এটা তো মনে হয় একে ফেলতে পারব।

একই সাথে আকার শুরুতে কিছু বেসিক জানতেই হবে। প্রথমে ফর্ম আর শেপ এগুলি বোঝা জরুরী। তারপরে একটার সাথে আর একটা ফর্ম জোড়া লাগিয়ে হিউম্যান ফিগার। সাথে ফিগার ড্রয়িং এর জেশচার। এরপর তিনটে মিলিয়ে কিছু ক্যারেক্টার ডিজাইনিং। হিউম্যান ফিগার আকার কারন আসলে যেহেতু এটা আমাদের সবার চেনা আর এখানে অনেক রকম ফর্ম পাশাপাশি মিলে থাকে তাই এটা একটা ভাল স্টার্টিং পয়েন্ট ড্রয়িং শিখতে।   খুব ছোট ছোট ভাবে জিনিসগুলিকে ভেঙ্গে নিয়ে একটা একটা করে শেখা-আর তার পাশা পাশি এপ্লাই করা। অনেক থিওরি জেনে এপ্লাই করতে গেলে শেখা হয় কম বরং অল্প শিখে সেটা দিয়েই কাজে লাগিয়ে কিছু করা গেলে সেটা মাথায় থাকে আরো ভাল।

ড্রয়িং এর বেসিক টপিক গুলি শিখতে অনেক সময় বোরিং লাগে কারন কেউ আমরা শুধু ফর্ম আকতে পছন্দ করি না, শুধু কম্পোজিশন করতে পছন্দ করি না, শুধু গোলক নিইয়ে শেডিং করতে পছন্দ করি না। আকতে পছন্দ গাছপালা, পথঘাট, নেচারাল বিউটি। তাহলে ক্যারেক্টার ডিজাইনের প্রিন্সিপাল শিখে সেই রুল গুলিকে গাছের শেপ সিমপ্লিফাই করতে কাজে লাগান। লাইট শ্যাডো কালার থিওরি নিয়ে সেগুলি এনভায়রনমেন্ট আর্টে কাজে লাগাতে পারেন। মনে রাখবেন শীখবেন অল্প-সেটাকে যত খানি সম্ভব কাজে লাগাবেন প্র্যাকটিস আর্ট ওয়ার্কে। একসাথে অনেক কিছু শিখে সেটাকে কাজে লাগান সম্ভব হয় না কখনো। ক্লাস ওয়ান এর কাউকে এস এস সি এর সিলেবাস দিয়ে দিলে সে কিন্তু পড়ে এ প্লাস পেতে পারেনা। এক্টূ একটু করে ধাপে ধাপে শিখতে শিখতে আগাতে হবে।  

 লাইভে স্কেচবুকিং, নেচার গাছপালা এবং কম্পোজিশন প্র্যাকটিস করতে পারেন। সব থেকে ভাল আসলে একটা বই বা টিউটোরিয়াল সিরিজ ফলো করে সেটাকে কম্পলিট করা। আগেই বলেছি- একেবারে শুরুতে ডিজিটাল আকান, কালারিং এই দুটোকে একেবারে মাথায় না নেয়াই ভাল। ঠেকে শিখেছি তাই বলতে পারি যে অনেক দিন ধরে টানা হ্যাচড়া কালারিং এসব করার পর আস্তে আস্তে বুঝতে পারি যে সলিড ড্রয়িং টা কতটা জরুরী। আমার কথা মেনে নেবার কোন দরকার নেই কিন্তু যদি আকতে আকতে মনে হয় যে কোথায় যেন একটা কিছু হচ্ছে না, তখন ড্রয়িং টাকে ঝালিয়ে নিবেন মনে করে। 

আর একটা খুব ইম্পরট্যান্ট ভাষা শিক্ষার মডেল হচ্ছে Acculturation-এটার মানে হচ্ছে আপনি যেই ভাষা টা শিখতে যাচ্ছেন, সেই ভাষা ভাষী দের সাথে আপনার সম্পর্ক। একবার মিউজিক শিখতে যেয়ে পড়েছিলাম সংগীত একটি গুরুমুখী বিদ্যা। ছবি আকাও আমার মনে হয় অনেক সময় এরকম। কোন আর্টিস্ট এর পাশে বসে আপনি যদি কাজ করা দেখেন এমন কিছু টিপস ট্রিক্স দেখতে পাবেন যেগুলো হয়ত কথায় লিখে বুঝান সম্ভব না কিন্তু সহজাত ভাবে কাজ করার সময় আর্টিস্টের হাতে চলে আসে।

তবে এর বিপরীতটাও সত্য-যদি আপনি সব সময় অনেক হাই স্কিলের আর্টিস্ট দের কাজ দেখেন তাহলে আপনার স্কিল লেভেলে কোন কাজ এক্সিকিউট করতে হয়ত জড়তা বোধ করবেন। তাদের সামনে আপনার নিজের কাজ গুলি মনে হবে তুচ্ছ এবং সেই ভয় থেকে আকা হবে কম। ফেসবুকের প্রো আর্টিস্ট গ্রুপে ঢুকলেন-সবার কাজ দেখে হতাশ হয়ে গেলেন-কালচারালি সেই গ্রুপে আপনি খাপ খাওয়াতে পারলেন না। এরকম হয়ে আকা ছেড়ে দেয়-অনেকেই কিন্তু আছে। খুব ভাল হয় যদি আপনি নিজের থেকে একটু হাই স্কিলের কোন আর্টিস্টের কাছ থেকে শিখতে পারেন-তাহলে আপনার প্রবলেম গুলি তার কাছে অনেক রিলেটেবল থাকবএ এবং তার কাছে আপনার কাজের এক্সেপটেন্স থাকবে বেশি।

এর সাথে আর একটা রিস্ক থেকে যায় যেটাকে বলে Pidginization-অর্থাৎ আপনার আকার গ্রোথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে হাইয়ার স্কিলের আর্টে এক্সেস না থাকার কারনে বা সেই চ্যালেঞ্জ না নেবার কারনে। তাই যখন বুঝতে পারবেন একটা লেভেলে কম্ফোর্টেবলি আকতে পারছেন তখন ই উচিত নতুন একটু হাই স্কিল চ্যলেঞ্জে ট্রাই করা এবং নিজের আগের লেভেলের সাথে ক্রমাগত প্রতিযোগিতা করে যাওয়া।  শেখার কোন শেষ নেই ছবির জগতে,তাই হচ্ছে না কিছু এ কথা ভাববেন না। যার আকা দেখে আপনি কপাল চাপড়াচ্ছেন, সেই আর্টিস্ট তার জায়গা থেকে আর একজনের কাজ দেখে হয়ত হাত কামড়াচ্ছে। সেলফ ক্রিটিক হওয়া জরুরী। সেলফ ক্রিটিসাইজ করার জন্য অন্য কারো আকা স্টাডি করুন, ফিল্ম স্টিল স্টাডী করুন। নিজে দেখুন রেফারেন্স কাজটার থেকে আপনার কাজটা কেন আলাদা হচ্ছে-কোথায় ভুল হচ্ছে। একটা ছবি দেখে দেখে আকেন, তারপরে ট্রেস করে আকেন, হুবুহু কালার পিক করে পেইন্টিং করেন, নিজে দেখে দেখে কালার বিল্ড আপ করেন-এই ধরনের স্টাডি প্রসেসের মধ্যে দিয়ে গেলেই ধীরে ধীরে বিষয়গুলি আয়ত্মে আসবে।

অনেক কিছুই মনে হয় পারি, পারি-কিন্তু কি যেন হচ্ছে না। আবার সেটার দিকে মন দিলে আর একটা দিক যেন ফসকে যাচ্ছে। এমন ভাবেই ঠেকে শিখে এগুতে হয় ছবি আকা শিখতে। এখানে দরকার আসলে ছবি আকার প্রতি ভালবাসা। আকার কাজটাকেই ভালবাসতে হয়-পেন্সিল নিয়ে দাগা দাগি, পাতার কোনায় ছোট্ট করে আকা একটা মুখ, খাতার পিছে পেনের দাগে কমিক, কাল ক্ষন খুৎ পিপাসা ভুলে একটা সাদা কাগজে আচড় কেতে যাওয়া-এই বিষয়গুলি যদি ভাল না লাগে তাহলে আকা শেখা অনেক জটীল। অসম্ভব বলছি না কারন অনেক ভাবেই ছবি তৈরী করা যায়-খাতা কলম কে পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ন আর একভাবে কেউ তার আর্টিস্ট সত্ত্বা কে পূর্নতা দিতে পারেন সেই আলাপে আমি যাচ্ছি না। 

আর একটা বিষয়ে প্রায়ই আমি ভাবতাম কোন স্টাইলে আঁকব? কোন স্টাইলে শিখব? স্টাইল বিষয়টাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী একঝন আর না আমি-১০-১২ বছর আকার পরে কারো একটা স্টাইল দাঁড়ায়। ১ মাসের ছবি আকার মাথায় দাঁড়িয়ে তাই স্টাইল, আর্ট পেজ, এসব নিয়ে মাথা ঘামান অর্থহীন। ১ মাস ছবি একে রাতা রাতি ভাইরাল সাকসেস হওয়ার স্টোরি থাকতে পারে-কিন্তু যদি আপনার মনে থাকে আকার টেকনিকাল এবং ভিজুয়াল কোয়ালিটি নিয়ে চিন্তা তাহলে লেগে থাকতে হবে। ভাইরাল হয়ত হতেও পারেন নাও পারেন-কিন্তু বেশ একটা লম্বা সময় রেগুলার না আকলে আর্ট স্কিল ইম্প্ররুভ করা কঠিন।

অনেক রকম কাজ দেখে হতাশ না হয়ে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য টুকু নিয়ে নিজের ভাল লাগার কাজে লাগাতে পারেন। এটা একটা খুব বড় শিক্ষা যেটা আমি নিজে এখন এসে কিছুটা রিয়ালাইজ করতে পারি। অনেক অনেক বিশাল একটা জগত আকার যেখানে আপনার ভাল লাগার জায়গাটা খুজে আপনাকে জগতে ঢোকার দরজাটা খুলতে হবে। তারপর জগতের যতটুকু ইচ্ছা ঘুরতে পারবেন কিন্তু সব দরজায় নক করে করে ফিরলে অনেক খানি সময় কেটে যাবে কিন্তু দেখা হবে না।  তাই চলতে থাকুক আকা আকি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন