বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

কী নাই

প্রবাস জীবনে এখনো হানিমুন ফেজ চলছে-এদিক সেদিক যাই, খাই দাই, ঘুরি ফিরি। ব্যস্ততা, দৈনন্দিন হিসাব নিকেশ, মাসের শেষে বিলের ধাক্কা, কাজ কর্ম কিছুই শুরু হয়নি এখনো। রঙ্গিন চশমা এটে তাই আশ পাশ দেখি, কিন্তু কি যেন নেই। রাস্তা পার হবার আগে বেল টিপে কানে হেডফোন গুজে নিশ্চিন্তে  চলে যাওয়া যায়-ডানে বামে তাকিয়ে পার হওয়ার সেই শিক্ষা অকেজো এখন। বাস স্ট্যান্ডে দাড়াও-গুগল বলে দিবে কোথায় আছে বাস, ফোনে নম্বর টিপে জেনে নিতে পার পরের বাস আসতে কত সময় লাগবে। "ভাই অমুক জায়গায় যেতে কোন দিকে যাব" -এই প্রশ্নে অচেনা কারো হাত নেড়ে মোড়ে যাবার আশ্বাসে হাটবার সময় ফুরিয়েছে। দেখতে দেখতে ট্রেন চলে আসে, স্কাই ট্রেন, মেট্রো রেল, এক্সপো লাইন, কানাডা লাইন। টিক টিক করে সময় বলে দিচ্ছে ২ মিনিটের মাথায় এসে যাবে ট্রেন-ঘড়ির কাটা ধরে ঠিক ঠিক নামিয়ে দেবে স্টেশনে। টুক টুক করে কার্ড ঘষটে নেমে ম্যাপ দেখে দেখে চলে যাও রাস্তা ধরে।

শহর থাকবে অনেক গোছান, উচু নিচু রাস্তার পাশ ধরে হেটে গেলে দূর দূরান্ত আকাশ দেখা যাবে। ঢাকায় মনে পড়ে সাগুফতা দিয়ে হেটে সামনে গেলে অনেক খানি আকাশ দেখা যেত। প্রতিবার দেখার সময় একটা আশ মিটিয়ে দেখে নেবার সাধ ছিল কারন আশংকা কদিন বাদেই হয়ত আকাশটাকে গিলে খাবে গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া আবাসিক বিল্ডিং আর ফ্লাইওভারের পিলার। এখন আকাশ দেখি-দূরের শহর দেখি-তারো পিছে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা মেঘ দেখি। দেখতে দেখতে পাখিরা উড়ে যায়-নটার সময় সন্ধ্যা নামে। একা রাস্তায় হেটে হেটে ফিরি। এই মনে হয় ছিনতাই হয়ে গেলাম নাকি এই বুঝি সামনে কেউ এসে ঠ্যাক দিল, ভাবতে ভাবতে দেখি পাশ দিয়ে নিশ্চিন্তে সাইকেল চালিয়ে গাছের সারি পেরিয়ে যাচ্ছে এক ভিনদেশি মেয়ে। বাতাস আছে, গাছপালা আছে, পাখির ডাক আছে, সারাজীবন পিসি তে গেম খেলার সময় দেখে আসা কোম্পানির লোগো সহ অফিস আছে, কিন্তু কী যেন নেই।

বুটিক শপের আশ পাশ দিয়ে ঘুরি, দেয়ালে আকা গ্রাফিটী দেখি, স্কোয়ামিশ মানুষের ইতিহাস ঘাটি গুগলে। সাদা,কালো, ধুসর বা এক রঙ্গা ফ্যাশনে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে হুট হাট চোখে পড়ে দু একজন আল গোছে নকশী কাটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। ঘুরতে এসে আইসক্রীম না খেলে কেমন হয়, ৭০ এর নামতা পড়ে খানিক হিসেব কষি-তারপর কি হবে এত ভেবে বলে চামচে কেটে নেই ব্ল্যাকফরেস্ট ব্লাস্ট এর স্কুপ। একই রকমই-৯০ দশকের বিদেশ দেখা আর ২১ এর গ্লোবাল যুগে এসে বিদেশের স্বাদ দেশের মতই লাগে। পাখি গুলো পায়ের উপর দিয়ে হেটে যায়-মানুষকে ভয় পাবার কোডটা ওদের জিনে এখনো লেখা হয়নি। চি চিই শব্দ করতে করতে থপ থপ করে হেটে বেড়ায় আশ পাশ দিয়ে-চুপ করে বেঞ্চের পাশে বসে শুনে নানান দেশের গল্প। বসে পড়ি প্রাইড ফ্ল্যাগ উড়তে থাকা একটা ইয়ট এর পিছে-এর মধ্যে লাইভ গান ভেসে আসে। স্কট জেকব নামের ইন্সটাগ্রাম গায়ক কালো টিশার্ট আর জিনসের শর্টস পরে স্যান্ডেল পায়ে গেয়ে যাচ্ছে অনলি নো ইউ লাভ হার হোয়েন ইউ লেট হার গো। 

নীল পানির মৃদু মন্দ স্রোত, বিকেলের পড়ে আসা রোদে ঢিলে সোয়েটার পরে সান কিসড ছবি, বাজারের পলিথিন ব্যাগে পেয়াজ, ব্যাগের ভেতরে পড়ে থাকা স্কেচবুক, গিটারের সামনে ১০ ডলারের সিডির বাক্স, দৌড়ে পার হয়ে যাওয়া রোলার স্কেট, বাচ্চাদের ছুটোছুটী-সবই  হোয়াইট নয়েজে মিলিয়ে যায়। যেন মুভির একটা সেটে বসে থাকা এক্সট্রা আমি-ছক বেধে হিসেব কষে চলছে সব পাশ দিয়ে। স্ক্রিপ্ট বেঁধে ডিরেকটর, সিনেমাটোগ্রাফার, আর্ট ডিরেকটর পরের শট টা বলে দিচ্ছেন। পারফেকশনের মধ্য দিয়ে কাঠের তক্তায় জুতার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে রেলিং এ ঝুকে তাকাই নিচে। পানিতে রিফ্লেকশন বলে দেয় হাতে তাকিয়ে দেখ-ধোয়া ওঠা সর ভাসা দুধ চার কাপটা নেই।

1 টি মন্তব্য: